মুসলিম জাতির ব্ল্যাক ডায়মন্ড ফুটবল জগতের কে এই যুবক? কি তার পরিচয়?
সেনেগালের দক্ষিনে অবস্থিত বাম্পালির একটি ছোট্ট গ্রামে ১০ই এপ্রিল ১৯৯২ সালে মুসলিম পরিবারে জন্ম হয় কৃষ্ণকায় একটি শিশু। বাবা মার সংসারে অভাব অনাটন ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী।
বাবা-মা-ভাই-বোন সব মিলিয়ে বড় পরিবার হওয়ায় পরিবারের ব্যয়ভার বাবা-মার সাধ্যের বাহিরে যাওয়ায়, শিশুটিকে বাবা মা রেখে দেন তার চাচার পরিবারের সাথে।
বাম্পালির সেই ছোট্ট গ্রামে চাচার কাছেই বড় হতে থাকেন শিশুটি। কঠিন দারিদ্রতার শৈশব পার করেন তিনি। শত দারিদ্রতার ভিতরে শৈশব পার করলেও তিনি ভবিষ্যতের জন্য বড় স্বপ্ন দেখতেন।
দারিদ্রতা আর অভাব-অনটনের কারণে তিনি স্কুলে যেতে পারেননি লেখাপড়া বলতে তিনি বলেন আমি কখনোই স্কুলে যায়নি।
ছোট্ট এই জীবন যোদ্ধা ব্ল্যাক ডায়মন্ড আর কেউ নন তিনি আমাদের বর্তমানের আফ্রিকার শীর্ষস্থানীয় একজন ফুটবলার সাদিও মানে।
২০০২ সালে বিশ্বকাপে তার দেশের জাতীয় দলের পারফরম্যান্স দেখে তিনি কৈশোর জীবনেই ফুটবলের ক্যারিয়ার গড়তে অনুপ্রাণিত হন।
সাদিও মানে ফুটবল প্রীতি দেখে তার চাচা ও তাকে ফুটবলের প্রতি অনুপ্রাণিত করেন। সাদি ও মানে প্রাথমিকভাবে এলাকাভিত্তিক ফুটবল খেলতে শুরু করে, পর্যায়ক্রমিক তার দেশের ভিতরেই যখন সুনাম অর্জন করতে থাকে তখন ক্লাবগুলোর নজর তার দিকে পরে।
সাদিও মানে ফ্রেঞ্চ ক্লাব মেটজ এর হয়ে সর্বপ্রথম ২০১২ সালের জানুয়ারিতে বিকল্প হিসেবে তাঁর পেশাদার অভিষেক হয়। ২০১২ সালেই অলিম্পিকে সেনেগাল দলের অংশ হিসেবে তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করেন। সাদিও মানে বেশ ভালো খেলেন এবং দলকে কোয়াটার ফাইনালে নিয়ে যান।
তার প্রথম লীগ মৌসুমে আগস্ট ২০১২ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল ক্লাব রেড বুল সালজবার্গে যোগ দেন। এখানে তিনি তার পারিশ্রমিক হিসেবে প্রায় চার মিলিয়ন ইউরো পাইতেন।
তিনি ক্লাবের হয়ে ৩১ শে অক্টোবর তার প্রথম হ্যাট্রিক তুলে নেন এবং অস্ট্রেলিয়ান কাপের তৃতীয় রাউন্ডে তার দলকে জিততে সাহায্য করেন। এছাড়াও তিনি অস্ট্রেলিয়ান বুন্দেসলিগায় তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স এর মাধ্যমে তার দলকে জয়ের দিকে নিয়ে যান।
এরপর ২০১৪/২০১৫ মৌসুমে সাদিও মানে ১১.৪ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে প্রিমিয়ার লিগের সাউথ্যাম্পটনে যোগ দেন।
এখানেও সাদিও মানের অভিষেক হয় আর্সেনালের বিরুদ্ধে ২-১ গোলের ব্যবধানে জয় নিয়ে।
তিনি একের পর এক দলের জন্য ভালো স্কোর করতে থাকেন এবং পুরো মৌসুমে তিনি তাদের একাধিক জয়ের স্বাদ এনে দেন। এই মৌসুমে দলের সর্বোচ্চ স্কোরার হিসেবে মৌসুম শেষ করেন।
২০১৫ সালে মে মাসে অ্যাস্টন ভিলার বিপক্ষে সাদিও মানে তিনটি গোল করেন, এখানেও ৬-১ ব্যবধানে জয় নিয়ে দ্রুততম হ্যাট্রকের জন্য একটি নতুন প্রিমিয়ার লিগ রেকর্ড গড়েন।
এরপর সাদিও মানে ২০১৬ সালে জুন মাসে ৩৪ মিলিয়ন পাউন্ডের ট্রান্সফার ফিতে লিভারপুল ফুটবল ক্লাবে যোগ দেন। এই পারিশ্রমিক তাকে সেই সময়ের সবচেয়ে দামি আফ্রিকান খেলোয়ার বানিয়েছেন।
তিনি আগস্টে প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক করেন আর্সেনালের বিরুদ্ধে ৪-৩ জয়ের জন্য চতুর্থ গোল করেন, এই চতুর্থ গোল টিমকে জয় এনে দেয়।
এই সম্পূর্ণ মৌসুমেই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স এর কারণে সাদিও মানে-কে ৯ ই মে ২০১৭ সালে লিভারপুলে প্লেয়ার অফ দ্যা সিজন হিসেবে মনোনীত করা হয়।
এরপর ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে তিনি ওয়াটফর্ড এর বিপক্ষে ৩-৩ ড্রতে লিভারপুলের প্রথম গোল করেন। এবং পরবর্তী ম্যাচ গুলোতেও তিনি ভালো পারফর্মেন্স করেন ২০১৭ সালে আগস্ট মাসে প্রিমিয়ার লিগ প্লেয়ার অফ দ্যা মান্থ নির্বাচিত হন।
১৪ ই আগস্ট ২০১৯-এ ২০১৯ UEFA সুপার কাপের ফাইনালের সময় সাদিও মানে চেলসির বিরুদ্ধে লিভারপুলকে জয় এনে দিতে ২ টি গোল করেন।
সাথে জানুয়ারি ২০২০ সালে তিনি এল হাদজি জিউসের পরে দ্বিতীয় সেনেগালিজ ফুটবলার ছিলেন, যিনি সিএফ আফ্রিকান বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচিত হন।
২০২১ সালে তিনি তার ১০০ তম লিভারপুল গোল করার পাশাপাশি তার ১০০ তম প্রিমিয়ার লিগ গোল করেন। সাদিও মানে একমাত্র ব্যক্তি যিনি আফ্রিকান তৃতীয় ব্যক্তি প্রিমিয়ার লিগে ১০০ বা তার বেশি গোল করেছেন।
সাদিও মানের ব্যক্তিজীবন:
সাদিও মানে সর্বপ্রথম তার পরিচয় তিনি একজন ঈমানদার মুসলিম। ফুটবল তার পেশা হিসেবে থাকলেও তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। এবং একজন ধর্মভীরু মুসলিম। বর্তমানে সাদিও মানে লিভারপুলের হয়ে খেলেছেন। তার তার প্রায় সাপ্তাহিক আয় ১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা, তারপরও তিনি খুব সাধারণ জীবন যাপন করেন।
তার সাধারণ জীবন যাপনের উদাহরণ স্বরূপ একটি সাংবাদিকের কথা বর্ণনা করতে পারি। সাদিও মানে একদিন সাংবাদিকের মুখোমুখি পড়ে যান, একজন সাংবাদিক তার হাতের ভাঙ্গা আইফোনকে নির্দিষ্ট করে তাকে জিজ্ঞেস করেন, এমন ভাঙ্গা ফোন আপনি ব্যবহার করেন কেন? এমন প্রশ্নে সাদিও মানে সাংবাদিকদের উত্তর করেন এটা আমি সার্ভিসিং করে নেব।
ওনাকে বলা হলো আপনি নতুন একটি ফোন কেন নিচ্ছেন না। সাদিও মানে উত্তরে বললেন এমন ফোন ইচ্ছে করলে হাজারটা কেনা যায়। চাইলেই দশটা ফেরারি, দুইটা জেট বিমান হাজার খানিক ডায়মন্ডের ঘড়ি কিনতে পারি। কিন্তু এসব কি আমার সত্যিই প্রয়োজন। তিনি বলেন এসব বৈশ্বিক বিষয় ছাড়া কোন কিছুই না।
কোন মানুষের রুচি নিম্নমানের না হলে ২০/৩০ হাজার ডলারের ঘড়ি হাতে দিয়ে ঘুরে না। আর এই বিলাসী জীবন আমার বা আমার সমাজের কি উপকারে আসবে।
আমার নিঃশ্বাস এই মুহূর্তে শেষ সেই মুহূর্তে আমার এসবের মালিকানাও শেষ।
সাদিও মানে তার ব্যক্তি জীবনের কথাগুলো বলতে গিয়ে তিনি বলেন আমি খুব দারিদ্রতার মাঝে বড় হয়েছি অভাবকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি।
তাই হয়তো আমি সেইসব দরিদ্র শিশুদের কথা ভাবতে পারি।
আমি লেখাপড়া করতে পারিনি তাই লেখা পড়ার গুরুত্ব টা হয়তোবা বুঝি।
শিক্ষার গুরুত্বটা অনেক, অনেক উচ্চশিক্ষিত রায় এ কথা বোঝতে চান না। যদি বুঝতো তাহলে হাজার হাজার শিশু অনাহারে ঘুমাতে যেত না পথের ধারে। মানুষ ধীরে ধীরে এত ভোগবিলাসী হয়ে উঠত না।
আমার বাবা সু চিকিৎসার অভাবে মারা গিয়েছিলেন যখন আমি ছোট ছিলাম, আমার নিজ অঞ্চলে স্বাস্থ্য পরিসেবার অভাব অকল্পনীয় ছিল।
“আমার মনে আছে আমার বোনও বাড়িতে জন্মেছিল কারণ আমাদের গ্রামে কোনো হাসপাতাল ছিল না। এটি প্রত্যেকের জন্য একটি সত্যিই, সত্যিই দুঃখজনক পরিস্থিতি ছিল।
আর ঠিক এই কারণেই গ্রামের সকল মানুষের কথা ভেবে তিনি গ্রামে একটি হাসপাতাল তৈরি করেন।
সাদিও মানে সব সময় তার দেশের যেকোনো দুর্যোগের সময় সরকারের পাশে থেকে সহযোগিতা করেন।
হয়তোবা আমি বিলাস বহুল বাড়ি তৈরি করিনি, কিন্তু অসংখ্য স্কুল তৈরি করেছি শিক্ষাকে সবার কাছে পৌঁছে দিতে।
হয়তোবা আমি নামিদামি পোশাকে ওয়ারড্রব ভর্তি করিনি, কিন্তু বস্ত্রহীনদের বস্ত্র দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
হয়তোবা নিজে দামি গাড়ি ব্যবহার করি না, কিন্তু অসংখ্য স্কুল শিক্ষার্থীদের স্কুল বাস দিয়েছি।
প্রতি সপ্তাহে দামি রেস্টুরেন্টে না খেয়ে আমি চেষ্টা করেছি অভক্ত শিশুদের মুখে খাবার তুলে দিতে।
কেননা আমি কোথা থেকে উঠে এসেছি সেটা আমি জানি, আমি জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছি।
সাদিও মানে অনেক মানবিক ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল। আমার দেখা একটি ভিডিও যেখানে কিছু সেবা কর্মীরা পানির বোতল গুলো নিয়ে যাচ্ছিল প্লেয়ারদের জন্য, সেখানে সাদিও মানে তাদেরকে সাহায্য করার জন্য যাবার সময় পানি কেস হাতে নিয়ে হাঁটতে থাকেন।
যখন তিনি তার গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করেন তিনি নিজ হাতে মসজিদের সমস্ত কাজ করে থাকেন, এমনকি মসজিদের ফ্লোর ধোয়ামোছা পরিষ্কার করার কাজও নিজ হাতে করছেন এমন ভিডিও দেখতে পাওয়া যায়।
মানুষের জন্য সাদিও মানের উদারতা:
তার গ্রামের বাড়ি বাম্বালিতে একটি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ৫০০,০০০ ইউরো দান করেছেন।
২০২০ সালের মার্চ মাসে মহামারী শুরুতে সাদিও মানে সেনেগালের কভিডের বিরুদ্ধে লড়াই করার জাতীয় কমিটিকে ৪১০০০ ইউরো দান করেছিলেন।
সাদিও মানে ২০১৯ সালে বসন্তের লিভারপুল তাদের সকল চ্যাম্পিয়নস লিগ অভিযানের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল, এই সময়ে সাদিও মানে বাম্বালিতে একটি স্কুলের অর্থায়নের জন্য ২ লক্ষ ৫০ হাজার ইউরো অনুদান দিয়েছেন।
ছাত্র-ছাত্রীদের আসা-যাওয়ার জন্য তিনি স্কুল বাস দিয়েছেন।
এছাড়াও নিজের এলাকায় মসজিদ মাদ্রাসা নিজ অর্থায়নে গড়ে তুলেছেন।
গ্রামের শিশুদের খেলার প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তিনি অর্থায়ন করে থাকেন।
নিজ এলাকায় সহ নিজের দেশের অভূক্ত শিশু এবং দরিদ্র শিশুদের জন্য কাজ করছেন।
এরকম অজানা আরও অনেক দান তার অভ্যন্তরীণেই রয়ে গেছে যা আমরা জানতে পারিনা। কেননা তিনি একজন খাঁটি মুসলিম। আর একজন খাটি মুসলিম দান করার সময় কাউকে বলতে পছন্দ করেন না। আমরা যে তথ্যগুলো এখানে দিয়েছি তা গুগোল তথ্যভান্ডার এবং সাদিও মানের দানে উপকৃত ব্যক্তিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
মন্তব্য: সাদিও মানে নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। কেননা একজন ভালো মানুষের ভেতরে যা যা গুণ থাকা দরকার সাদিও মানে ভেতরে তা লক্ষ্য করা যায়। তিনি একজন ধর্মভীরু মুসলিমও বটে। তিনি সবসময় চেষ্টা করেন ইসলামিক জীবন বিধানেই চলাফেরা করতে। আর একজন মুসলমানের এটাই হওয়া উচিত তার জীবনধারা নিয়ন্ত্রিত করা উচিত ইসলামের বিধান দিয়ে।
সাদি ওমান যেমন ফুটবল জগতের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র তেমনি ব্যক্তিজীবনেও একটি জ্বলজ্বলে নক্ষত্র। তিনি আলোকিত করেছেন ফুটবল বিশ্বকাপ। তিনি আলোকিত করেছেন সেনেগালের মাটিকে।
তিনি ইসলামী জীবন বিধানে নিজেকে পরিচালিত করে গোটা বিশ্বে ইসলামের মাধুর্য বুঝিয়েছেন।
No comments